Welcome to OUSPER

Monday, May 16, 2011

সবাইকে কেন শূণ্য থেকে শুরু করতে হবে?

গত দু'দিন ধরে আমার ভেতর একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে। চিন্তাটা হারিয়ে যাওয়ার আগেই লিখে ফেলার চেষ্টা করছি। লেখাটি পড়ার পর কেউ কেউ হয়তো ভাববেন, আমি হয়তো কোনও সায়েন্স ফিকশন লেখার পরিকল্পনা করছি। তাই এমনটা ভাবছি। কিন্তু আমি দিব্যি দিয়ে বলছি যে, আমার মাথায় গল্পের প্লটের কোনও কমতি নেই। বরং সেগুলো লিখে ফেলার সময়ই করে উঠতে পারি না। তাই পাঠকদের জন্য একটু ভূমিকা করলাম, তারা যেন তাদের চিন্তাটাকে ভিন্ন খাতে নিয়ে না যান। তাদের চিন্তাটা যতটা সম্ভব আমার চিন্তার কাছাকাছি আনতে পারবো, ততটাই হয়তো আমার চেষ্টার সফলতা হবে।

এবারে মূল লেখায় ফিরে আসি।

আমার চার বছরের একমাত্র মেয়ে সুনিভা স্কুলে যেতে শুরু করেছে। ১৭ই নভেম্বর ওকে স্থানীয় একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো। এবং পরের দিন (বৃহঃস্পতিবার) থেকেই ওর কাস শুরু হয়ে গেলো। এর আগে অবশ্য ওকে আরেকবার স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছিল। সেটা ঢাকায়। ঢাকার স্কুলগুলো প্রায় বছর খানেক আগে থেকেই ছাত্রছাত্রী ভর্তি করিয়ে বসে থাকে। পরিকল্পনা ছিল, এই বছর তল্পি-তল্পা গুছিয়ে বাংলাদেশে চলে যাবো। কিন্তু তখন নাকি মেয়েকে কোনও ভালো স্কুলে ভর্তি করানো যাবে না, সীট পাওয়া যাবে না। তাই এই বছরের প্রথম দিকে ঢাকার ধানমন্ডিতে একটি স্কুলে ওকে ভর্তি করিয়ে দিলাম। এই বছরের জুলাই থেকে ওর কাস শুরু হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আমাদের পরিকল্পনা একটু পরিবর্তন করতে হলো। সুনিভার ভর্তিটিও চিঠি লিখে বাতিল করতে হলো। তাই জুলাই থেকে আর ওর স্কুলে যাওয়া হলো না। সেটা এসে ঠেকলো এই নভেম্বরে।



বৃহঃস্পতিবারটি আমার জন্য একটু বিদঘুটে। আমার অফিসের একটি টিম কানাডার অটোয়াতে, আরেকটি টিম লন্ডনে, আরো দুটো টিম ভারতের ব্যাঙ্গলোর এবং পুনেতে। আমাকে পাঁচটি এলাকার টাইম জোনে বসবাস করতে হয়। তাই কখনও খুব ভোরেই মিটিং শুরু হয়ে যায়। সেটা চলতে থাকে রাত অব্দি। বৃহঃস্পতিবারটি হলো এমন একটা দিন। সকাল ছ’টা থেকে একটার পর একটা মিটিং - কোনটা রেখে কোনটা বাদ নেই।

সুনিভা তার মা’র সাথে বাসে করে স্কুলে যাবে বলে প্রস্তুতি নিয়েছে। সে তার জীবনে প্রথম কাধে ব্যাগপ্যাক ঝুলিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। ব্যাপারটা ভেবেই আমার ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। আমি মুহুর্তেই ফিরে গেলাম প্রায় পয়ত্রিশ বছর আগে, যেদিন আমি একটা “শ্লেট” আর “আদর্শ লিপি” বই নিয়ে স্কুলের দিকে পা বাড়িয়েছিলাম। আমার ঠিক মনে নেই, কে আমাকে স্কুলে দিয়ে এসেছিল। মা-বাবা বেঁচে থাকলে তারা হয়তো বলতে পারতেন। কিন্তু এটা মনে আছে, আমার ছিল কাঠের ফ্রেমের ভেতর আটকানো পাথরের শ্লেট, আর দু-রঙ কাগজে ছাপানো আদর্শলিপি বই। ভোরের সূর্য্য ওঠার সাথে সাথে, বারান্দায় মাদুর পেতে সেই শ্লেটে বর্ণমালা লেখা, আর ”অ তে অজগর” পড়তে হতো। তারপর ভিরু ভিরু বুকে স্কুলের দিকে পা বাড়ানো। সেই যে পথ চলা, তারপর থেকে কতটা পথ চলে এলাম। একবার মনে হলো, কতটা পথ! আবার মনে হলো, কিভাবে চলে গেলো এই সময়টা! সেই বিশাল পথ পরিক্রমায় সুনিভাও তার পা রাখতে যাচ্ছে। জীবনের বিভিন্ন বাঁকে পড়ে একদিন মেয়েটি কোথায় গিয়ে দাড়াবে, আমরা কেউ বলতে পারি না। তবে আমি একটা জিনিস বলতে পারি, সুনিভা তার প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিনটির কথা বারবার মনে করার চেষ্টা করবে। আর সেদিন যদি ওর মনে হয়, সে তার বাবার হাত ধরে স্কুলে যেতে পারেনি, তার থেকে কষ্টের আর কিছু ওর জীবনে হতে পারে না। আমি মুহুর্তের ভেতর একটা মিটিং বাতিল করে সুনিভাকে বললাম, ”চলো, আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি।”

সে কি তার আনন্দ! চার বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে। কিন্তু চোখে কত যেন আগ্রহ, আর অবাক করা চাঁদের হাসি। কাঁধে ব্যাগপ্যাক নিয়েছে, নিজে নিজেই জুতো পড়েছে, নিজেই গাড়িতে উঠেছে। আমার ছোটবেলার তেমন কোনও ছবি নেই, আর স্কুলে যাওয়ার ছবির তো প্রশ্নই আসে না। আমি সুনিভার জন্য ওর কিছু ছবি তুলে রাখি। স্কুলের মাঠে ওকে নামিয়ে দিয়ে, ওর কপালে আদর করে দিয়ে বললাম, ”মা, তুমি ভয় পাচ্ছো না তো?”

দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে সে বললো, “না, বাবা।”

সুনিভা তার মা’র হাত ধরে স্কুল ভবনের দিকে হেটে যায়; আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। তারপর বাসায় এসে আবার অফিসের কাজ। আমি সারাটা দিন আর অফিসে যাওয়ার ফুসরত পেলাম না। বাসা থেকেই অফিসের কাজ করলাম। এর ভেতর সুনিভা স্কুল থেকে ফিরে এসেছে। সে তার স্কুলের গল্প করছে। পরের দিন (গতকাল) শুক্রবার। আমি আবারো আমার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সুনিভা তার মা’র সাথে আবারো স্কুলে যায়। আগামী সপ্তাহেই সুনিভার জন্মদিন। নভেম্বর মাসে যাদের জন্মদিন, স্কুলে তাদেরকে জন্মদিনের কেক কেটেছে। তারপর বালিতে বালতি নিয়ে খেলেছে, গান করেছে, আঁকাআঁকি, বর্ণমালা শেখা ইত্যাদি। তার গল্প অনেক। কিন্তু আমি যতই ওকে দেখি, ততই আমি হারিয়ে যাই আমার চিন্তায়। ওর দিকে তাকিয়ে আমি ভাবতে থাকি - শুরু হয়ে গেলো ওর জীবন - লম্বা জীবন, দীর্ঘ যাত্রা।

ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আমি ভাবতে থাকি, সবে মাত্র ও বর্ণমালা শিখছে, অংকের সংখ্যা চিনছে। বাংলা ইংরেজী দুটোই শিখতে হচ্ছে। তারপর এগুলো লিখা শিখবে। তারপর যতই দিন যাবে, ততই জটিল হতে শুরু করবে। যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, জ্যামিতি, সরল অংক, পাটিগণিত, ক্যালকুলাস, ডাইনামিক্স, কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স, ভূগোল, ইতিহাস, সমাজ বিদ্যা, সাহিত্য, গান, শিল্প, জীব বিদ্যা, রাজনীতি, ব্যবসা, প্রযুক্তি - এগুলো শিখতে ওর লাগবে আরো ২০/২১ বছর। তারপর তাকে শুরু করতে হবে কাজের জীবন। বিশটি বছর!

এর অর্থ হলো, মানুষকে একটি সাধারন জীবন শুরু করতে হলেও মোটামুটি ২০ বছর লেখাপড়া করতে হয়। কারো কারো জন্য হয়তো আরো বেশি। তারপর গিয়ে সে কিছু একটা করার যোগ্যতা অর্জন করে। তারপর আর সে বেঁচে থাকে কতদিন? তার জীবনে প্রস্তুতি নিতে নিতেই তো বিশাল একটা সময় শেষ।

মানুষকে এই লম্বা সময় ধরে প্রস্ততি নিতে হয় তার মূল কারণ হলো, আমাদের সবাইকেই শুরু করতে হয় শূণ্য থেকে। আমি যেভাবে অ-আ শুরু করেছিলাম, আমার মেয়েও প্রায় সেখান থেকেই শুরু করেছে। কিছু জিনিস যে এগুয়নি তা নয়, তবে সেটা খুবই সামান্য। আমি শ্লেটে লিখেছি, ও লিখে কাগজে নয়তো বোর্ডে। আমি পঞ্চম শ্রেনীতে গিয়ে ক্যালকুলেটর দেখেছি, কিন্তু সে এখুনি ইউটিউব থেকে গান বাজাতে পারে, কমপিউটারে বসে আকাআকি করতে পারে। অন্য বাচ্চারা হয়তো আরো বেশি কিছুতে বেড়ে উঠছে। কিন্তু এগুলো হলো টুলস। মৌলিক কাজটি কিন্তু শুরু করতে হচ্ছে সেই শূণ্য থেকেই। ওটাই ওর বেসিক। এক + এক যোগ করলে, দুই হবে - এখান থেকেই ওকে শুরু করতে হচ্ছে। কিন্তু মানব সভ্যতার অন্যান্য দিকগুলোতো এমন নয়। একটি জাতি সময়ের তালে যতটা সামনে এগুয়, পরের জেনারেশন তো সেখান থেকেই শুরু করতে পারে। কিন্তু জ্ঞান আহরনের পদ্ধতিটি এখনো সেই পুরনোই রয়ে গেছে। জ্ঞান ট্রান্সফার করার পদ্ধতিটি তেমন এগুয়নি। এমন তো হতে পারতো, আমি যেটুকু জ্ঞান আহরন করেছি, আমার মেয়ে সেখান থেকেই শুরু করবে। তাহলে মানব সভ্যতা কত বেশি দ্রুত এগিয়ে যেতো, কেউ একবার ভেবে দেখেছেন?

আমার মেয়ের বয়স যখন দশ এগারো হবে, তখন যদি আমি আমার ব্রেইন থেকে যাবতীয় জিনিস ওর মাথায় ট্রান্সফার করে দিতে পারতাম, এবং সবাই যদি সেটা করতে পারতেন, তাহলে বিশাল একটা উন্নতি হতো। দুই আর দুই যোগ করলে চার হবে, এটা কিভাবে চার হলো সেটা তো ওর জানার দরকার নেই। ওটা যে চার হয়, সেটা জানাই তো ওর জন্য জরুরী। আমরা প্রতিদিন কত কঠিন সমস্যার সমাধান আজকাল কমপিউটার দিয়ে করে ফেলি। কিন্তু আমাদের কি জানার দরকার আছে, সেটা কিভাবে হচ্ছে? যার জানার দরকার, সে জানলেই হলো। কিন্তু একজন ব্যবহারকারীকে তো জানার দরকার নেই, গুগল কিভাবে কোটি কোটি ওয়েবপেজ থেকে তার প্রয়োজনীয় পেজটি খুজে এনে দেয়। জ্ঞান যাত্রার পথে যদি একই পদ্ধতি কাজে লাগানো যেত, তাহলে মন্দ হতো না।

আমার ধারণা, এটা এক সময়ে ঘটবে। মানুষ তার জ্ঞানকে মুহুর্তেই অন্য মানুষের ভেতর কপি করে দিতে পারবে। আজ থেকে বিশ বছর আগে কি আমরা কেউ জানতাম, ইন্টারনেট নামে একটা জিনিস থাকবে, এবং সেখানে যা চাইবেন মুহুর্তেই খুজে পেয়ে যাবেন? আমাদেরকে একটা ছোট জিনিস খুজে পাওয়ার জন্য লাইব্রেরী থেকে লাইব্রেরী ঘুরে বেড়াতে হতো। জ্ঞান ট্রান্সফার ছিল খুবই ধীর গতির। কিন্তু গত বিশ বছরে সেটা অনেক দ্রুততর হয়েছে। আমার বিশ্বাস, আগামী বিশ/ত্রিশ বছরের মধ্যেই এমন কিছু তৈরী হবে, যা দিয়ে আরো দ্রুত জ্ঞান ট্রান্সফার করা যাবে। সেটা পুরো ব্রেইন ট্রান্সফারই হতে হবে, এমন কিছু নয়। তবে, কিছু একটা বের হবে, যা দিয়ে ছোট শিশুরা তাদের জীবন শূণ্য থেকে শুরু করবে না।

ইস, আমি যদি সেটা দেখে যেতে পারতাম!


Writer:
স্যান্টা কারা, ক্যালিফোর্নিয়া

No comments:

Post a Comment