Welcome to OUSPER

Tuesday, September 6, 2011

মেসি-জাদু দেখার দিন

এত দিন ধরে চলা মেসি আর আর্জেন্টিনা শব্দযুগলের অনন্ত মিছিলের মধ্য থেকে নাইজেরিয়া নামটি যেন মর্যাদার সঙ্গে ভেসে উঠল কাল সংবাদ সম্মেলনেই। প্রশ্ন উঠল, নাইজেরিয়ার সঙ্গে ম্যাচে নামার আগে তাঁদের মনের মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করবে না?
মুখে হাসির রেখা এঁকেও আলেসান্দ্রো সাবেলা ‘তীব্র’ প্রতিবাদ করলেন, ‘প্রতিশোধ? কিসের প্রতিশোধ? মানুষের মধ্যে প্রতিশোধপরায়ণতা কাজ করতে পারে না। এটা তো একটি ফুটবল ম্যাচই, আমরা চাইব জিততে।’
তাহলে গত জুনে আবুজায় নাইজেরিয়ার কাছে আর্জেন্টিনার অহংকার যে ক্ষতবিক্ষত হলো ৪-১ গোলের পরাজয়ে, নতুন কোচ সেসব মাথায় নিয়ে আসেননি! মেসি-মাচেরানো-ডি মারিয়াদের দুষ্টু হাসির মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা নেই!
কিন্তু আসলেই কি তাই? আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া মুখোমুখি হওয়া মানেই যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সে যুব বিশ্বকাপ বলুন, অলিম্পিক ফুটবল কিংবা আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ১৯৯৪ এর পর ২০০২ বিশ্বকাপ, তারপর গত দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে কী দেখেছে গোটা বিশ্ব? নাইজেরিয়ার শারীরিক শক্তিমত্ত ফুটবলের সঙ্গে আর্জেন্টিনার স্কিলের লড়াই। আর্জেন্টিনাই বরাবর জিতে এসেছে ন্যূনতম ব্যবধানে। সর্বশেষ এই জুনের প্রীতি ম্যাচে বদলা নিয়েছে নাইজেরিয়া। হয়তো একটু নির্মমভাবে। আর্জেন্টিনা দলে মেসি ছিলেন না, তেভেজ ছিলেন না, মাচেরানো ছিলেন না, আগুয়েরো ছিলেন না। সার্জিও বাতিস্তা একটা আনকোরা দল নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। কিন্তু পরাজয়টা গিলতে হয়েছিল ‘কুইনাইনের’ মতো। আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের মহাশক্তিধর প্রধান হুলিও গ্রন্ডোনা পর্যন্ত কুপিত হয়েছিলেন কোচের প্রতি।
ঠিক আছে, বাংলাদেশের মানুষ সাবেলার কথামতো আজ সন্ধ্যার এই ম্যাচে ফুটবলের সৌন্দর্যেই মোহিত হতে চায়, প্রতিশোধের আগুনের হলকা গায়ে লাগাতে নয়। বাংলাদেশ যে আর্জেন্টিনার ফুটবলের একটা উপনিবেশ হয়ে গেছে, তার মূলে আগ্রাসন ছিল না, শক্তির পূজা ছিল না; ছিল জাদুর সম্মোহন, ফুটবলের পেলব শিল্প। আবেগের কোনো নিবিড় তার বেয়ে মনের গহিনে ঢোকা এক আকুল করা সুর। এত দিন ডিয়েগো ম্যারাডোনা নামে মোহিত হয়েছে এই ছোট্ট ভূখণ্ড। ‘ফুটবল-ঈশ্বর’ এখন মাঠে নেই, কিন্তু উত্তরাধিকার সঁপে গেছেন বিশ্ব ফুটবলের বর্তমান রাজকুমার লিওনেল মেসির হাতে। সেই মেসি কাল মায়াবী বিভ্রম ঘুচিয়ে পা রাখলেন ঢাকায়। হোটেল রূপসী বাংলায়।
সকালটা সবে দুপুরের কোলে মাথা রেখেছে। আকাশের অথই নীলে ভাসছে সাদা মেঘের ভেলা। এই শুভ্র শরতের বার্তা নিয়েই যেন বাংলাদেশে পৌঁছে গেল আকাশি-সাদা ফুটবল দল—লা আলবিসেলেস্তি। মেসির আর্জেন্টিনা। আগে যা ছিল ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা, এখন তা মেসির আর্জেন্টিনা। বলতে পারেন, মেসি ও অন্যদের দল। চার দিন আগে কলকাতায় ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে ম্যাচের আগেও যখন অধিনায়কের বাহুবন্ধনী তাঁর হাতে ছিল না, তখনো এটি ছিল মেসির দল। আর আজ ওই বাহুবন্ধনী পরার পর দলটা কার বলে বোঝাতে হবে না।
আর্জেন্টিনার সাংবাদিক দানিয়েল বললেন, কলকাতার সঙ্গে ঢাকার অনেক ব্যবধান। কলকাতা কোলাহলের নগর, তুলনায় ঢাকা শান্ত সমাহিত। কলকাতায় মানুষের মধ্যে এক ধরনের উন্মত্ততা আছে, ঢাকায় আছে নীরব ভালোবাসা।
আমরাও তা-ই বলতে চাই। গোলাপের পাপড়ি বিছানো পথে হোটেলে ঢুকেছেন মেসিরা। দূর প্রবেশপথে সার বেঁধে মেসি আর আর্জেন্টিনা-ভক্তদের মিছিলে উন্মত্ত আবেগ দেখা যায়নি, বরং তা নিরুচ্চারে বলছিল সযত্নে সাজিয়ে রাখা ভালোবাসার কথা। বিউগল আগমনী সুর তোলেনি। শঙ্খ বাজেনি। রাস্তায় ব্যানার-ফেস্টুন জানান দেয়নি অভ্যর্থনার মাতাল হাওয়া। ভালোবাসা বয়ে যায় নীরবে। আর্জেন্টিনা-প্রেম, মেসিপ্রেম দেখা যায় রাতে টেলিভিশনের পর্দায়। বার্সেলোনার মেসিই বেশি করে এ দেশের ফুটবল রোমান্টিকদের আত্মার আত্মীয়। আর একটা কথা, মেসি জানেন না, আর্জেন্টিনা জানে না, শেষ মুহূর্তেই এ দেশটা জেগে ওঠে। এই ম্যাচের টিকিট বিক্রির তথ্যও তো তা-ই বলে। বিশ্বের সেরা ফুটবলারটি দেশের মাটিতে পা ফেলার আগেও যে টিকিট অর্ধেকও বিকোয়নি, তাই কাল বিকেল নাগাদই প্রায় শেষ। বাকি টিকিট বিক্রির শেষ সময়সীমা আজ বেলা দুইটা পর্যন্ত, কিন্তু নিশ্চিত থাকুন সকালেই সব ফুরিয়ে যাবে।
বাংলাদেশে মেসিদের আগমন যে জয়ডঙ্কা বাজিয়ে হলো না, তার আরেকটা কারণ হতে পারে ‘বিস্ময়’। বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আর পারিশ্রমিকের দিক দিয়ে সবচেয়ে দামি ফুটবলারটি, যাঁর এক দিনের আয় প্রায় ২৭ হাজার ইউরো, মানে প্রায় ২৮ লাখ টাকা, তিনি আসছেন—এটা স্বপ্নের মতোই লেগেছে। সত্যি সত্যিই তিনি যখন এলেন, তখনো ঘোর কাটেনি বিস্ময়ের। হোটেলের করিডরে যখন পা পড়ল মেসির, অজস্র চোখের তারায় নাচল আনন্দ।
উচ্চতা পাঁচ ফুট সাড়ে ছয় ইঞ্চি, পূর্বসূরি ম্যারাডোনার চেয়ে খর্বকায়, কিন্তু তাঁকে দেখেই ফিসফিসানি শোনা গেল, ‘এত ছোট, এত ছোট!’ হ্যাঁ, খর্ব শরীরের কারণেও মেসির আরেক নাম ‘লা পুলগা’—দ্য ফ্লি, মাছি। মক্ষিকার মতোই মাঠে তাঁর উপস্থিতি। দুনিয়ার এমন কোনো ডিফেন্ডার নেই, তাঁকে আটকায়। আর এই যে কোচ সাবেলা, তাঁর নাম হলো এল মাগো—জাদুকর। মাঠের জাদুকরের সঙ্গে জুটি বাঁধলেন মাঠের বাইরের জাদুকর। আর এই জুটির দ্বিতীয় ম্যাচটাই আজ সন্ধ্যায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। জাদু দেখার অপেক্ষায় ক্ষণ গুনছে এখন বাংলাদেশ। আর অন্য গোলার্ধে থাকা সেই দেশটি? নিশ্চিতই এক, দুই, তিন...করে গুনছে মুহূর্ত। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে প্রতিশোধ নেওয়ার, তার চেয়েও বেশি করে হয়তো অর্জনের আলোয় রঙিন হওয়ার অপেক্ষায়। আর্জেন্টিনা যে এখন বিশ্ব ফুটবলে ঘুমিয়ে পড়া দৈত্য!

No comments:

Post a Comment